আগরতলা , ২৬ এপ্রিল (রােমেল চাকমা) : অনিশ্চিয়তার কাল মেঘ কেটে গেছে । চোখে মুখে তাদের এখন নিশ্চয়তার ছাপ । দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর নিদারুণ দুঃখ , কষ্ট দুর্দশার শেষে নিজের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও নিশ্চয়তা পেয়েছেন তারা । পেয়েছেন স্থায়ী ঠিকানা । মুছে গেছে নিজ দেশে শরণার্থী নামের তকমা । তারা আজ আনন্দে আপুত । কৃতজ্ঞও । তারা কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি , স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের প্রতি । কারণ তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই তাদের দীর্ঘ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে । ১৯৯৭ সাল থেকে মিজোরামে জাতি বিরােধের শিকার হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল কয়েক হাজার রিয়াং জনজাতি অংশের মানুষ । উদ্বাস্তু হিসেবে তাদের স্থান হয়েছিল অবিভক্ত কাঞ্চনপুর মহকুমার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ।
এরমধ্যে দু'দশক সময় পেরিয়ে ২০১৮ সালে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার । মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বিপ্লব কুমার দেব রিয়াং শরণার্থীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার দেন । কেন্দ্রীয় সরকার , ত্রিপুরা সরকার , মিজোরাম সরকার ও রিয়াং শরণার্থী প্রতিনিধিদের মধ্যে আলােচনার পর কয়েক শতাধিক পরিবার নিজ ভূমিতে ফিরে যান । কিন্তু একটা বড় অংশই নতুন করে অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কায় মিজোরামে ফিরে যেতে অসম্মতি প্রকাশ করেন । যে কারণে তাদের কিভাবে পুনর্বাসন দেওয়া যায় সেটা নিয়ে নতুনভাবে প্রশাসনিক চিন্তাধারা শুরু হয় । পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুরু হয় কেন্দ্রীয় সরকার , ত্রিপুরা সরকার , মিজোরাম সরকার ও রিয়াং শরণার্থী প্রতিনিধিদের মধ্যে আলােচনা । দফায় দফায় আলােচনা ও বৈঠক শেষে ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার , ত্রিপুরা সরকার , মিজোরাম সরকার ও রিপ্রেজেন্টেটিভ অর্গানাইজেশনের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । সেই চুক্তি অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত শুরু হয় ত্রিপুরার মাটিতে রিয়াং শরণার্থীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া । গত ১৯ এপ্রিল কাঞ্চনপুর ও পানিসাগর মহকুমা থেকে ৮ শতাধিক রিয়াং শরণার্থী পরিবারকে স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য উত্তর ত্রিপুরা জেলার পানিসাগর মহকুমার কাসকাউ ও ওয়াইবাকছড়া রানীছড়া এবং ধলাই জেলার লংতরাইভ্যালী ও আমবাসা মহকুমায় নিয়ে আসা হয় । এরমধ্যে ধলাই জেলাতে রয়েছে চার শতাধিক পরিবার । রাজ্য প্রশাসনের এই উদ্যোগে নবজন্ম পেয়েছেন রিয়াং শরণার্থীগণ । তাইতাে তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে রাজ্য সরকারের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা ।
লংতরাইভ্যালী মহকুমা সদর ছৈলেংটা থেকে প্রায় ১০ কিলােমিটার দূরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গড়ে দেওয়া হয়েছে শরণার্থীদের থাকার অস্থায়ী ব্যারাক । প্রকৃতির কোলে লবনছড়া এডিসি ভিলেজের বঙ্গাফা পাড়ার পাহাড়ি এলাকায় একসঙ্গে মােট ১০ টি টিনের ছাউনি দেওয়া ব্যারাক নির্মাণ করে দিয়েছে প্রশাসন । প্রত্যেকটিতে পানীয়জল ও শৌচালয়ের সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছে । এই শিবিরে আপাতত ২০৬ টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে । প্রত্যেকের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ৯ কেজি চাল ও ১ কেজি লবণ দেওয়া হয়েছে । এছাড়া প্রত্যেকদিন দুবেলা করে আপাতত প্যাকেট করা খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে । সবজি সহ রান্নার অন্যান্য সামগ্রীও সরবরাহ করা হচ্ছে । রাজ্য প্রশাসনের এই ঐকান্তিক প্রয়াসে আপুত রিয়াং শরনার্থীরা । কিভাবে তারা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাবেন সেটাই যেন ভেবে পাচ্ছেন না । বঙ্গাফা । পাড়া ক্যাম্পের টু ডিসপ্লেসড সেটেলমেন্ট কমিটির সেক্রেটারি ই জে চরকি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী , কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পাশাপাশি ধন্যবাদ জানিয়েছেন ।
সেই সাথে সুদীর্ঘ এত বছর ধরে তাদের উপর চলা নানা দুঃখ দুর্দশার কথা অকপটে তুলে ধরেছেন তারা । জজিরাম চরকি , কালাজয় রিয়াং , ধনুরাম মেসকা , প্রদীপ রিয়াং , কিরাধন রিয়াংরা নয়া ঠিকানা পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত । একবাক্যে সবাই জানালেন বর্তমানে প্রশাসনের সহায়তায় তাদের কোন সমস্যা নেই ।
একই চিত্র ধরা পড়েছে আমবাসা মহকুমার হাদুকলাউ পুনর্বাসন ক্যাম্পেও । পুনর্বাসন , সরকারি সাহায্য , গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা হয় এই ক্যাম্পের সেক্রেটারি উত্তম কুমার রিয়াংয়ের সাথে । স্পষ্টতই তিনিও স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী , কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাদের প্রত্যেকের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান । এর পাশাপাশি কথা হয় জোৎসােয়ানা রিয়াং এবং অমিতা রিয়াংয়ের সাথে । তারাও তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন । হাদুকলাউ পুনর্বাসন ক্যাম্পে বর্তমানে ২০৭ টি পরিবার অবস্থান করছেন । তাদের প্রত্যেকের খোঁজখবর নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও মহকুমা প্রশাসনের আধিকারিকগণ । লংতরাইভ্যালী এবং আমবাসা মহকুমার দুটি শিবিরের প্রত্যেকটি ব্যারাকেই রিয়াং জনজাতিদের থাকার সুবিধার জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে । বৈদ্যুতিক পাখা সহ সােলার লাইটেরও ব্যবস্থা হয়েছে । সবাই আশায় বুধ বেঁধে আছেন আগামী কিছুদিনের মধ্যেই সরকারি সহায়তায় তারা ব্যারাকের জীবন ছেড়ে নিজের মতাে জীবন গড়ে তুলতে পারবেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন