রাজন্যবর্গ ও রাজ শাসন : ত্রিপুর রাজবংশের আদি পুরুষ দ্রুহ্য কিরাত দেশ জয় করে কপিল নদীর তীরে ত্রিবেগ স্থলে প্রথমে রাজপাট স্থাপন করেন । মহারাজ ত্রিপুর , দ্রুহ্যর পুত্র দৈত্যের ছেলে । ত্রিপুর অত্যাচারী ও নাস্তিক ছিলেন । ক্রোধান্বিত শিবের ত্রিশূলাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় । নিজ নাম অনুসারে ত্রিপুর রাজ্যের নাম “ ত্রিপুরা ” করেন । তিনি ছিলেন নিঃসন্তান ।
চতুর্দশ দেবতার প্রকাশ : অরাজক অবস্থা নিরসনে প্রজাদের আবেদনে রাজ্যে চতুর্দশ দেবতার প্রকাশ হয় স্বয়ং মহাদেবের আদেশে । এই চতুর্দশ দেবতা হচ্ছেন — হর , উমা , হরি , মা ( লক্ষ্মী ) , বাণী , কুমার , গণেশ , ব্রহ্মা , পৃথিবী , সমুদ্র , গঙ্গা , অগ্নি , কামদেব ও হিমালয় । মহাদেবের বরে ত্রিপুর - রাণীর গর্ভে ত্রিলােচনের জন্ম হয় । মহারাজ ত্রিলােচন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন । চতুর্দশ দেবতার পূজার জন্য তিনি পূজারী আনেন সমুদ্রতীরের এক দ্বীপ থেকে । এই পূজারীরাই চন্তাই - দেওড়াই নামে প্রসিদ্ধ । পূজার উদ্বোধন হয় আষাঢ় মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে । বরবক্ৰ ( বরাক ) তীরে রাজপাট স্থানান্তর করেন ত্রিলােচন - পুত্র মহারাজ দাক্ষিণ — বড় ভাই দৃকপতির কাছে যুদ্ধে পরাজয়ের পর । রাজপাট স্থাপিত হয় খলংমাতে । এই খলংমা সুদীর্ঘকাল রাজপাট ছিল । দাক্ষিণের ৫২ তম পুরুষ পৰ্য্যন্ত এখানেই রাজত্ব করেন । মহারাজ কুমার মনু নদীর তীরে শ্যাম্বলনগরে নূতন করে রাজপাট স্থাপন করেন । ত্রিপুরাব্দের প্রচলন মহারাজ প্রতীত শ্যাম্বল ত্যাগ করে আরও দক্ষিণদিকে বর্তমান ত্রিপুরায় আসেন । ঐতিহাসিকদের মতে , এই সময় থেকেই ।
ত্রিপুরাব্দের প্রচলন : ত্রিপুরায় মহারাজদের রাজত্ব অনুমান ৫৯০ খৃষ্টাব্দ থেকে | প্রতীতের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ হামতরফা বা যুঝার রাঙ্গামাটি জয় করে সেখানে রাজপাট স্থাপন করেন । প্রায় এই সময় থেকেই উদয়পুর অঞ্চলে রাজধানী স্থাপিত হয় । পরে মহারাজ উদয়মাণিক্য তার “ উদয়পুর ” নামকরণ করেন নিজের নামানুসারে । যুঝার উনবিংশ পুরুষ মহারাজ সিংহতুঙ্গের আমলে ভারতে মুসলমান রাজত্ব আরম্ভ হয় । লক্ষণ সেনের পরাজয়ের পর বাংলাও মুসলমানের হাতে চলে যায় এবং গৌড়ে আরম্ভ হয়ে যায় নবাবী আমল ।
ত্রিপুরার বীরাঙ্গণা রাণী মহাদেবী : মহারাজা সিংহতুঙ্গ যখন ত্রিপুরার সিংহাসনে উপবিষ্ট তখন মুসলমান আমল আরম্ভ হয়ে গেছে । উত্তর ভারতে মুসলমান শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । বাংলার রাজা লক্ষণসেনের পরাজয়ের ফলে বাংলাদেশও মুসলমানের হাতে চলে গেছে । দেখতে দেখতে গৌড়েও মুসলমান আমল শুরু হয়ে যায় । তখন হীরাবন্ত খাঁ নামক এক ধনাঢ্য জমিদার ত্রিপুরার সীমান্তে বাস করতেন । গৌড়ের নবাব থেকে সনদ পেয়ে তিনি মেহেরকুলের ( কুমিল্লা এলাকা ) উপর কর্তৃত্ব করতেন এবং বিনিময়ে নবাবকে করের পরিবর্তে এক নৌকা মূল্যবান ধন - রত্ন উপহার দিতেন । ত্রিপুরেশ্বর এ কথা জানতে পারলেন এবং বুঝতে পারলেন , এইসব মূল্যবান ধন - রত্ন ত্রিপুরা রাজ্য থেকেই সংগ্রহ করে নবাবকে নজর হিসাবে পাঠান হচ্ছে । মহারাজের খুব রাগ হল ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে একদিন হঠাৎ ত্রিপুর - সৈন্য মেহেরকুল আক্রমণ করে সর্বস্ব লুট করে আনল । হীরাবন্ত পরাস্ত হয়ে গৌড়ের নবাবের দরবারে ধর্ণা দিলেন । হীরাবন্ত নবাবকে বুঝালেন , নবাবের রাজস্বের উপর ত্রিপুরার মহারাজের লােভ হয়েছে ; তাই ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করা উচিত । নবাব সম্মত হলেন ।
মহারাজের সহিত প্রবল প্রতাপ গৌড়ের নবাবের যুদ্ধ বেঁধে গেল । নবাবের প্রায় ২/৩ লক্ষ সৈন্য ত্রিপুরা সীমান্তে হানা দিলে মহারাজ ভয় পেয়ে গেলেন । নিরুপায় ভেবে তিনি সন্ধির পরামর্শ করতে লাগলেন । রাজার এই ভীরুতার কথা রাণীর কানে গেল । রাণী মহাদেবী রাগে জ্বলে উঠলেন । মহারাজকে তিনি বললেন , হে নরনাথ , তুমি একি কথা বলছ ? পূর্বপুরুষের কীৰ্ত্তি লােপ করতে চাও ? ছিঃ ছিঃ ! যদি নবাবের সৈন্য দেখে ভয় পেয়ে থাক তবে অন্তঃপুর আরামে বাস কর , আমি রণে ঝাপিয়ে পড়ি ।
এই বলে রাণী দামামা পিটলেন ; সৈন্যরা সব সারি দিয়ে দাঁড়াল । রাণী বললেন , “ কি বল ত্রিপুর সৈন্যগণ ! তােমরা কি যুদ্ধ চাও , না চাও না ? তােমাদের রাজা সিংহের কুলে শৃগাল হয়ে জন্মেছে ; ভয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকতে চায় । রাজা ভয়ে ভীত হলেও আমি ভয় পাইনা । কুলের মান রাখতে আমি যুদ্ধে যাব । তােমাদের প্রাণে যদি তিলমাত্র বল থাকে তবে আমার সঙ্গে চল । ” রাণীর কথায় সৈন্যদের মনে সাহস বাড়ল সকলে সমস্বরে বলল , ‘ আমরা ভয় করি না মা , - আমরা ভয় করিনা । তুমি মা হয়ে যদি যুদ্ধে যাও , আমরা সন্তান হয়ে তােমার পিছনে যাব । ”
রাণীর আনন্দের সীমা রইল না । রণরঙ্গিনী মূর্তিতে তিনি - ভৈরবী মূৰ্ত্তি ধরলেন । যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন অন্নপূর্ণা হয়ে তিনি সৈন্যদের তৃপ্তিমত ভােজন করালেন । পরদিন রাণী দেশের স্বাধীনতার জন্য হাতীর পিঠে চড়ে অগণন সৈন্যসহ যুদ্ধ যাত্রা করলেন । তালে তালে রণ দামামা বাজল । ত্রিপুরা রাজ্যের সে একদিন ! এর পরে ত্রিপুরেশ্বর আর কি করে বসে থাকতে পারেন ! তিনিও সকলের সঙ্গে যুদ্ধে যােগ দিলেন ।
উভয় সৈন্যদল মুখােমুখী হতেই তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল । ত্রিপুর কুললক্ষ্মী যুদ্ধে অবতীর্ণা ; কুলদেবতা চৌদ্দ দেবতার আশীর্বাদ বর্ষিত হলাে । গৌড়ের সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে লাগল । এমন সময় মহারাজ আকাশে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন । তখন সন্ধ্যা হয় হয় । ধূসর আকাশে এক নরমুণ্ড নাচছে । মহারাজ দেখলেন , সৈন্যরাও দেখল ; দেখে সকলে ভয়ে শিউরে উঠল । মঙ্গল আশঙ্কায় মহারাজ রামকৃষ্ণ নারায়ণ স্মরণ করলেন । প্রবাদ আছে যে , লক্ষ সৈন্য মারা গেলে আকাশে এইভাবে নরমুণ্ড ধেই ধেই করে নাচে । মহারাজ বুঝলেন , এই যুদ্ধে লক্ষ সৈন্য পালাল । ত্রিপুরার বিজয় কেতন উড়ল । জয়মাল্য পরে রাণী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাড়ী ফিরলেন । নিহত হয়েছে । এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেল এবং গৌড়ের সৈন্য রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার পথে হীরাবন্তের মেহেরকুল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলাে । ভারতের ইতিহাসে এই রাণীর আসন গড়মণ্ডলের রাণী দুর্গাবতী , ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ এবং চাঁদ সুলতানার সমান ।
আগরতলা : সিংহতুঙ্গের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ মহারাজ হরিরায় ওরফে ডাঙ্গরফার ১৮ পুত্র ছিল । মহারাজ তাঁর পুত্রদের মধ্যে রাজ্যের শাসনভার ভাগ করে দেন । সেই মতে পুত্র আগরফা পান আগরতলা অঞ্চল । তাঁর নাম থেকেই আগরতলা নামের উৎপত্তি । কেউ কেউ অবশ্য বলেন , আগর বন থেকে আগরতলা নাম হয়েছে ।
মাণিক্য উপাধি : খৃষ্টীয় ত্রয়ােদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে গৌড়ের নবাবের সঙ্গে মহারাজ ডাঙ্গরফার প্রীতি - প্রণয় ঘটে । তখন গৌড়ের নবাব বখতিয়ার খাঁ । মহারাজ তার কনিষ্ঠ পুত্র রত্নকে গৌড়েশ্বরের দরবারে পাঠান । রত্নের ব্যবহারে খুশী হয়ে নবাব রত্নকে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসান ( অবশ্য যুদ্ধে জয় করে ) এবং তাঁকে “ মাণিক্য ” উপাধি প্রদান করেন । এর পর থেকেই ত্রিপুরার মহারাজদের মাণিক্য উপাধি ।
রাজমালারচনা : মহারাজ ধৰ্ম্মমাণিক্য রতুমাণিক্যের অধস্তন তৃতীয় পুরুষ । তিনি বীর যােদ্ধা ছিলেন । বাংলা আক্রমণ করে তিনি জয়ী হন । আরাকান - রাজকেও পরাজিত করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন । রাজমালা রচনা তাঁর অক্ষয় কীৰ্ত্তি । বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর— দুই পুরােহিত দ্বারা কবিতায় রাজমালা রচনা করান তিনি । খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজমালা রচনা করা হয় । কুমিল্লার বিখ্যাত ধর্মসাগর তারই কীর্তি । রাজত্বকাল ১৪৩০-১৪৬২ খৃঃ আব্দ ধরা যেতে পারে ।
১৪৬৪ খৃঃ অব্দে ধন্যমাণিক্যের অভিষেক হয় । প্রধান সেনাপতি রায় কাচাগের কন্যা কমলাদেবীকে তিনি বিবাহ করেন । এই কমলাদেবীর নামেই কসবার বিখ্যাত কমলাসাগর । রায় কাচাগের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির বলে তিনি ( ধন্যমাণিক্য ) কুকি রাজ্য জয় করেন । খণ্ডল , বরদাখাত , মেহেরকুল , - গঙ্গামণ্ডল , বগাসার , বেজুরা , ভানুগাছ — সবই তিনি জয় করেন । তখন রাজধানী উদয়পুরে ।
ত্রিপুরাসুন্দরীর প্রতিষ্ঠা : ধন্যমাণিক্যের অবিনশ্বর কীৰ্ত্তি হচ্ছে , উদয়পুরে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির নির্মাণ এবং তাতে দেবীর প্রতিষ্ঠা । কষ্টি পাথরে গড়া কালিকা মূর্তি । দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী । মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫০১ খৃঃ অব্দে । সুবিখ্যাত ধন্যসাগর ধন্যমাণিক্যই খনন করান । তাঁর মৃত্যু হয় ১৫১১ খৃঃ অব্দে । রাণী কমলাদেবী তার চিতায় সহমৃতা হন ।
উদয়পুরের জগন্নাথ মন্দির : দেবমাণিক্য ও বিজয়মাণিক্যের প্রধান সেনাপতি দৈত্যনারায়ণ উদয়পুরে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা করান । কাল – ১৫২৮ খৃঃ অব্দের কাছাকাছি । দৈত্যনারায়ণের ছােট ভাই দুর্লভনারায়ণ খুবই অত্যাচারী ছিলেন । মনে হয় , তাঁর নাম থেকেই সােনামুড়ার দুর্লভনারায়ণ গ্রাম । উদয়পুরের অমরসাগর , অমরপুর এবং অমরপুরের অমরসাগর মহারাজ অমরমাণিক্যের কীর্তি । ১৫৮৪ খৃঃ অব্দে তিনি রাজা হন । অমরসাগর উৎসর্গকালে অমরমাণিক্য তাম্রশাসন দ্বারা যে চতুর্দর্শ গ্রাম উৎসর্গ করেন , তাহাই এখন চৌদ্দগ্রাম ( বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় ) নামে পরিচিত ।
কৈলাসহরে রাজপাট : অমরমাণিক্যের সময়েই আরাকানপতি মঘরাজ উদয়পুর দখল করেন । সময়টা ষােড়শ শতাব্দীর একেবারে শেষ ভাগ । তখন কৈলাসহরে রাজপাট স্থানান্তরিত হয় । পুত্র রাজধরমাণিক্য অতঃপর উদয়পুর উদ্ধার করেন । রাজধর - পুত্র যশােধর মাণিক্যের আমলে আবার উদয়পুর বেদখল হয় । দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের ফৌজরা তা দখল করে , সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে । প্রায় আড়াই বছর দখলে রেখে মােগল সৈন্যরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় মহামারীর ফলে ।
কসবার কালীবাড়ি : মহারাজ কল্যাণমাণিক্যের কীর্তি কল্যাণসাগর – যা ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের বাড়ীর সংলগ্ন পূৰ্ব্বদিকে অবস্থিত । তার অপর কীৰ্ত্তি কসবার কালীবাড়ী , সময় সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি । তাঁর নাম থেকেই খােয়াই মহকুমার কল্যাণপুর এবং কসবার কল্যাণসাগর । রাণী গুণবতীর নামে গুণসাগর , সহােদর ভ্রাতা জগন্নাথের নামে এক মাইল লম্বা জগন্নাথ দীঘি , আর সম্রাট শাহজাহানপুত্র সুজার নামে কুমিল্লার সুজা মসজিদ ও সুজাগঞ্জ বাজার ( গােমতীর তীরে ) মহারাজ গােবিন্দমাণিক্যের কীর্তি । তার অপর কীর্তি চন্দ্রনাথে চন্দ্রশেখরের মন্দির নির্মাণ । সময়- সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ ।
সমসের গাজী : এই সময়ে ত্রিপুরার ভাগ্যাকাশে এক ধূমকেতুর আবির্ভাব হয় । দক্ষিণ শিক নিবাসী এক মুসলমান প্রজা , সমসের গাজী ক্রমেই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেন । এক সামান্য রমণীর গর্ভে , জনৈক ফকিরের ঔরসে তাঁর জন্ম । বিজয়মাণিক্যের ( ৩ য় ) মৃত্যুর পর সমসের গাজী নিজেকে চাকলে রােশনাবাদের অধিপতি বলে ঘােষণা করেন । পরবর্তীকালে যুবরাজ কৃষ্ণমণিকে পরাভূত করে রাজধানী উদয়পুর দখল করে নেন এবং নিজেকে ত্রিপুরার অধিপতি বলে ঘােষণা দেন । তবে প্রজাদের হৃদয় জয় করার মানসে ধৰ্মৰ্মাণিক্যের ( ২ য় ) পৌত্র বনমালীকে ‘ লক্ষণমাণিক্য ' নাম দিয়ে সিংহাসনে বসান এবং তার আড়ালে থেকে নিজে রাজকার্য পরিচালনা করেন । পরাজিত যুবরাজ কৃষ্ণমণি উদয়পুর ত্যাগ করে পুরাতন আগরতলায় বসবাস করতে থাকেন । সমসের গাজীর অত্যাচার ও দস্যুপণায় প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন । সুযােগ বুঝে কৃষ্ণমণি মুর্শিদাবাদে নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত করান । তখন নবাব মীর কাশিম । ন্যায়পরায়ণ মীরকাশিম কৃষ্ণমণিকে ত্রিপুরার অধিপতি বলে ঘােষণা করেন এবং সমসেরকে গ্রেপ্তার করান । বিচারে সমসেরের প্রাণদণ্ড হয় এবং বন্দী অবস্থায়ই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় । সময় —১৭৬০ খৃঃ অব্দ । বিজয়মাণিক্য ও সমসেরের রাজত্বকাল প্রায় কুড়ি বছর ( ১৭৪০ ৬০ খৃঃ ) ।
ইংরেজ শাসন আরম্ভ : ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে মহারাজ কৃষ্ণমণি পরাজিত হন । রাজ্যে ইংরেজ পক্ষে রেসিডেন্ট রূপে নিযুক্ত হন লিক সাহেব এবং তিনিই ত্রিপুরায় প্রথম রেসিডেন্ট । তার পুরাে নাম মিঃ রল লিক ( Mr. Ralph Leeke ) । সময় —১৭৬১ খৃঃ অব্দ । এই তথ্য সংগৃহীত হয়েছে উমাকান্ত একাডেমীর প্রাক্তন ও প্রয়াত প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী মহােদয় প্রণীত “ রাজমালা ’ থেকে । কেউ কেউ বলেন এ বি ডাব্লিও পাওয়ার রাজ্যের প্রথম রেসিডেন্ট বা পলিটিকেল এজেন্ট এবং তার নিযুক্তি ১৮৭১ খৃঃ অব্দে । অর্থাৎ রল লিকের ১১০ বছর পরে । আমি একমত নই । তবে “ রেসিডেন্ট ” আর “ পলিটিকেল এজেন্ট ” শব্দ দুইটির মধ্যে তফাৎ থাকলে অবশ্য অন্য কথা । চাকলে রােশনাবাদ শাসনের জন্য তিনি ( লিক ) চাকলায় বৃটিশ শাসনতন্ত্রের প্রবর্তন করেন । পাৰ্ব্বত্য ত্রিপুরায় অবশ্য রাজশাসনই বলবৎ থাকে । পুরাতন আগরতলায় চতুর্দশ দেবতা মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য পুরাতন আগরতলায় রাজপাট স্থাপন করেন । উদয়পুর থেকে বৃন্দাবন চন্দ্রের বিগ্রহ ও চতুর্দশ দেবতা নিয়ে এসে এই নূতন রাজপাটে তিনি পুনঃস্থাপন করেন । সময় ১৭৬১ খৃঃ অব্দ । রাজধানী স্থানান্তরকালে উদয়পুরের শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের বিগ্রহ কুমিল্লায় স্থানান্তরিত করা হয় ।
মহারাজা বীরচন্দ্র : মহারাজ বীরচন্দ্র ছিলেন নানাদিকে কীৰ্ত্তিমান । তিনি ছিলেন একাধারে কবি , সাহিত্যানুরাগী , শিল্পানুরাগী , শিক্ষানুরাগী , গুণগ্রাহী , সমাজ সংস্কারক ও শাসন সংস্কারক । স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তাঁর হৃদয়বিদারক কবিতা— “ দেবি ! তুমিতাে স্বরগপুরে , জানিনাকো কতদূরে .... । উত্তরকালে সবিশেষ প্রশংসিত হয় । তাঁর ভগ্নহৃদয়কালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের “ ভগ্ন হৃদয় ” । কলকাতায় প্রাইভেট সেক্রেটারীকে পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথকে তিনি এজন্য অভিনন্দন জানান । ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যােগসূত্র এখান থেকেই ।
মহারাজা বীরবিক্রম : ১৯৪১ ইংরেজীর এপ্রিলের প্রথম ভাগে ঢাকা জেলার রাইপুরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় । উদ্বাস্তু হিন্দুরা দলে দলে ত্রিপুরায় আসেন । মহারাজ বীরবিক্রম তাদের সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাদের থাকা - খাওয়ার ব্যবস্থা করেন । শুধু তাই নয় , সহরতলীর অরুন্ধতীনগরে কলােনী স্থাপন করে তাদের পুনর্বাসনও দেন । ১৯৪৬ ইং সনের অক্টোবর মাসে নােয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত হিন্দুরা দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় আসলে মহারাজ তাদেরও গ্রহণ ও আশ্রয়দান করেন । ১৩৪৮ বাংলার ( ১৯৪১ ইং ) ২৫ শে বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মহারাজ বীরবিক্রম আগরতলায় “ রবীন্দ্র জয়ন্তী দরবার আহ্বান করেন এবং ঐ দরবারে কবিকে “ ভারত ভাস্কর ” উপাধিতে ভূষিত করেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন