।। গৌতম দাস ।।
জিরানীয়া, ১০ জুলাই : শেষ হলো ত্রিপুরার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও জনাবেগে পূর্ণ খার্চি উৎসব ও মেলা ২০২৫। গত ৩ জুলাই সকাল ১১ টায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা.) মানিক সাহা চতুর্দশ দেবতাবাড়ির এই মহোৎসবের শুভউদ্বোধন করেন। এই উৎসবের মাধ্যমে বিশ্বাস, লোকাচার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যেমন সংরক্ষণ হয়, তেমনি গড়ে ওঠে মানবিক সম্পর্কের মেলবন্ধন। খার্চি উৎসব তাই শুধু একটি ধর্মীয় আয়োজন নয় বরং এটি ত্রিপুরার আত্মপরিচয়ের এক গৌরবময় অধ্যায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পর্যটন মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরি, বিধায়ক তথা মেলা কমিটির চেয়ারম্যান রতন চক্রবর্তী, বিধায়ক সপ্না দেববর্মা, পুরাতন আগরতলা পঞ্চায়েত সমিতির চেয়ারম্যান ঝর্ণা রাণী দাস, তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সচিব প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার জেলাশাসক ডা. বিশাল কুমার, পুলিশ সুপার ড. কিরণ কুমার, কে জিরানীয়ার মহকুমাশাসক অনিমেশ ধর, সমাজসেবী রাজেশ ভৌমিক প্রমুখ।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও খার্চি মেলা উপলক্ষে আয়োজক কমিটি একটি মূল ভাবনা বা থিম নির্ধারণ করেছে, যা মেলার আধ্যাত্মিক ও সামাজিক আবহে বিশেষ মাত্রা যোগ করে। গত বছর মেলার থিম ছিল সবুজই ভবিষ্যৎ যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্বকে তুলে ধরেছিল। সেই উপলক্ষে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিতরণ করা হয়েছিল। যা মেলার সামাজিক সচেতনতার দিকটি প্রকাশ করেছিল। এই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের খার্চি মেলায় মূল ভাবনা নির্ধারিত হয়েছে 'অপারেশন সিন্দুর'। সম্প্রতি কাশ্মীরের পহেলগাঁও -এ সংঘটিত এক নারকীয় সন্ত্রাসী হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানে অবস্থিত সন্ত্রাসবাদী ঘাটিগুলি গুড়িয়ে দেয়। এই আভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীর জওয়ানরা চরম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মেলা কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন এর মধ্যদিয়ে দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর সেনানিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের পক্ষ থেকে চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসরণ করে বাংলা ও ককবরক ভাষায় উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশিত হয়, যা মেলার পরিবেশকে এক অনন্য আবেগ ও মর্যাদার সংযোজন ঘটায়। ভাষা ও সুরের এই সংমিশ্রণ যেন একজোট করে দিল ত্রিপুরা বৈচিত্র পূর্ণ সাংস্কৃতিকে। বাংলা ভাষার কোমলতা ও ককবরক ভাষার প্রাণ স্পন্দনে ভরপুর এই সঙ্গীত মুহূর্তেরই মঞ্চে এনে দিল এক অসাধারণ উদ্দীপনা, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আবেগ এবং উৎসবের গর্বিত সূচনা। খার্চি উৎসব উপলক্ষে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে উৎসব স্থলের দুই প্রধান মঞ্চ-কৃষ্ণমালা মঞ্চে ও হাবেলী মুক্ত মঞ্চে আয়োজিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিশেষত হাবেলী মুক্ত মঞ্চটি হয়ে ওঠে শিশু-শিল্পীদের এক প্রাণোচ্ছল, সৃজনশীল মিলনক্ষেত্র। প্রতিদিন এখানে অংশগ্রহণ করে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ জন খুদে প্রতিভা, যারা তাদের সৃজনশীতলা ও সাংস্কৃতিক দক্ষতার মাধ্যমে মঞ্চটিকে রঙিন করে তোলে। এই মঞ্চে পরিবেশিত হয় সমবেত বাদ্যযন্ত্র অনুরণন, সমবেত সংগীতের সুরেলা ধারার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া পরিবেশনা, সমবেত ও একক নৃত্যের নান্দনিক ছন্দ, একক আবৃত্তি ও সমবেত আবৃত্তির কন্ঠ স্বরের মাধুর্য এব্য একক সঙ্গীতের গুণমুগ্ধ করানো সুর। শিশুশিল্পীদের এই অংশগ্রহণ শুধু তাদের প্রতিভার প্রকাশ নয়, বরং এটি ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল আভাস।
হাবেলী মুক্ত মঞ্চ যেন খার্চি উৎসবের হৃদয়ে বয়ে আনে সৃষ্টির স্বয়ং রঙ ও আনন্দের গীতিময় জোরার। খার্চি উৎসব ২০২৫-এর সুবর্ণ আবহে, উৎসবস্থলের অন্যমত আকর্ষনীয় কেন্দ্রে বিন্দু হয়ে উঠেছে কৃষ্ণমালা মঞ্চ। প্রতিদিন দুপুর থেকে শুরু করে গভীর রাত অবধি এই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে একের পর এক মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করেছে সুর, নৃত্য ও আনন্দের অপার ছোঁয়ায়। এই মঞ্চে পরিবেশিত হয়- বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার দ্বারা সমবেত সংগীত, রাজ্যের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পীদের দ্বারা একক সংগীত, রাজ্যের জনজাতি সাংস্কৃতিক দলের দ্বারা জনজাতি নৃত্য ও সঙ্গীত। রাজ্যের বিশিষ্ট শিল্পীদের পরিবেশিত লোকগীতি ও বাদ্য যন্ত্রানুষ্ঠান, ভক্তিমূলক গান, পদ্মপূরাণে, নিমাই সন্ন্যাস প্রভৃতি। তাছাড়া স্থানীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের অনুষ্ঠিত প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন এই মঞ্চে অংশগ্রহণ করেছে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ জন শিল্পী, যারা তাদের প্রতিভা, নিষ্ঠা ও আবেগ দিয়ে কৃষ্ণমালা মঞ্চকে পরিনত করেছেন ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত নিদর্শণে। এই মঞ্চ যেন হয়ে উঠেছে উৎসবের হৃদয় সম্পন্দন যেখানে প্রতি পদক্ষেপে ধ্বনিত হয়েছে সংস্কৃতির ছন্দ এবং প্রতিটি মুহূর্তেই বয়ে এনেছে সৃষ্টির কলরব। খার্চি উৎসবের সাংস্কৃতিতে আয়োজনে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে আগত খ্যাতনামা লোকশিল্পী সায়নী গাঙ্গুলী ও শৈবাল রায় এর মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। এই দুই বিশিষ্ট শিল্পী পাঁচ ও ছয় জুলাই দুই দিন ধরে তাদের সুর, কণ্ঠ ও আবেগময় উপস্থাপনায় কৃষ্ণমালা মঞ্চমালা মঞ্চের পরিবেশে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন। এই পরিবেশনগুলি নিঃসন্দেহ খার্চি উৎসব ২০২৫ এর সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য ও শিল্পমানকে অনেক উঁচুতে তুলে ধরেছে।
এবারের খার্চি উৎসবের আবহাওয়া ছিল সম্পূর্ণ অনুকূল, আর তারই সুফল স্বরূপ মেলার প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের ভির ছিল চোখে পড়ার মত। মনোরম পরিবেশ ও সুশৃঙ্খল আয়োজনে যেন উৎসবের সৌন্দর্য আরো বহুগুণে বেড়ে ওঠে। এই জনসমাগমে সুবিধা পেয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। মেলা প্রাঙ্গণে দোকানপাট গুলোতে প্রতিদিনই জমজমাট কেনাকাটা হয়েছে। মেলার এক প্রবীণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণ দাস জানান, গত বছরের তুলনায় এবছর আমাদের আয় অনেকটাই ভালো হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় ক্রেতারা স্বাচ্ছন্দ্যে মেলায় এসেছেন, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিক্রিয় উপর। যদিও শেষ দিকে বৃষ্টির জন্য কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। তিনি বলেন, খার্চি উৎসব কেবল ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক মিলন নয়, এটি আমাদের ব্যবসায়িক জীবনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। উৎসবের ভিড়ে যেন প্রাণ ফিরে পায় এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
খার্চি উৎসব ২০২৫ এর বর্ণিল আবাহে, প্রতি বছরের ন্যায় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে এবারও শিশুদের জন্য আয়োজিত হল বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। যা শিশুদের কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও চারু শিল্পের প্রতি আগ্রহকে উৎসাহিত করে। এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে ৬ জুলাই সকাল ৮:৩০ টা থেকে, উৎসব প্রাঙ্গণের হাবেলী মুক্ত মঞ্চে। মোট তিনটি বিভাগে প্রায় ১০০ জন শিশু প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে, যারা রঙ তুলি আর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা তাদের কল্পনার জগৎ ও সমাজের প্রতিফলন। ২ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিষয় ছিল যেমন খুশি আঁকো, যেখানে তারা তাদের নির্ভেজাল ভাবনা ও প্রানবন্ত রঙে মনের ছবি ফুটিয়ে তোলে। ৬ থেকে ১ বছর পর্যন্ত জন্য নির্ধারিত ছিল একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহর, ৯ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা অংশ নেয় সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐতিহ্যের মিলনতীর্থ।
খার্চি মেলা। এই প্রতিযোগিতা শুধু একটি শিল্প কর্মশালা নয়, বরং শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সমাজচেতনার এক অন্যান্য প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। তাদের আঁকা প্রতিটি চিত্রকর্ম যেন ছিল ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক গর্ব, পরিবেশ প্রেমী ও সৌন্দর্য্যবোধের সজীব প্রতিচ্ছবি।
মেলার পঞ্চম দিনে, কৃষ্ণমালা মঞ্চে এক অন্যান্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এলাকার আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অথচ শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জনকারী ছাত্রছাত্রী এবং বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের সন্মানে মঞ্চটি ভরে ওঠে সম্মান ও আবেগের দীপ্তিতে। মেলা কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক রতন চক্রবর্তী তাদের হাতে তুলে দেন সম্মান ও প্রেরণার বার্তা। এদিন মোট ১২ জনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাদের মধ্যে ৫ জন দিব্যাঙ্গজন, ৬ জন কৃতি ছাত্রছাত্রী এবং ১ জন স্কাউট এন্ড গাইড এর সদস্য যিনি ন্যাশনাল ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারে ভূষিত। কৃতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন যার নাম বিল্পব ভৌমিক। সে এবছর দারিদ্রতাকে জয় করে আই আই টি পাটনায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। দারিদ্র কিংবা প্রতিবন্ধকতা তাদের অগ্রযাত্রা থামাতে পারেনি। বরং অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায়ে তারা নিজেদের পথ নির্মাণ করেছে।
১ জুলাই খার্চি মেলার সমাপ্তি অনুষ্ঠানে এক হৃদয়গ্রাহী পরিসমাপ্তি ঘটল রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন ও সর্বজনীন এই উৎসবের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাংসদ রাজীব ভট্টাচার্য, আগরতলা পুর নিগমের মেয়র তথা বিধায়ক দীপক মজুমদার, বিধায়ক রতন চক্রবর্তী সহ অন্যান্য অতিথিগণ। সকলেই শান্তিপূর্ণভাবে মেলা সম্পন্ন হওয়ার জন্য প্রশাসন, অংশগ্রহণকারী শিল্পী, কর্মী, দর্শনার্থী ও শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বক্তৃতায় তারা বলেন, রাজ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় থাকায় এমন বৃহৎ একটি মেলা নির্বিঘ্নে সফলভাবে আয়োজিত হয়েছে। জাতি ও জনজাতির মধ্যে সুদৃঢ় সংহতি ও ঐক্য এই খার্চি মেলার মাধ্যমে আরও বলিষ্ঠ হয়েছে, যা রাজ্যের সামগ্রিক সামাজিক ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। সমাপ্তি মঞ্চে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে আয়োজিত শিশুদের জন্য তিনটি বিভাগে অনুষ্ঠিত বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার ও শংসাপত্র তুলে দেওয়া হয়। সত্যিই এবারের খার্চি উৎসবে প্রকৃতির অনুকূলতা ও প্রশাসনের সুচারু ব্যবস্থাপনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক সঞ্চার যা উৎসবকে করে তুলেছে আরও তাৎপর্যপূর্ন ও সফল।
এই মহোৎসব শেষ হলো আগামী বছরের নতুন আশা ও প্রতীক্ষার বার্তা নিয়ে। হৃদয়ে রয়ে গেল অনেক স্মৃতি, আনন্দ আর উৎসবের রেশ যা আগামী দিনে এক নব চেতনার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন