আগরতলা,৭ জুলাই : রাজ্যের অর্থমন্ত্রী প্রনজিৎ সিংহ রায় শুক্রবার বিধানসভায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবর্ষের জন্য যে বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটে মূলধনী ব্যয় রাখা হয়েছে ৫৩৫৮.৭০ কোটি টাকা। বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৯৩৯ কোটি টাকা, সড়ক উন্নয়ন ক্ষেত্রে ১৩৬০ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ১৭৫৬ কোটি টাকা এবং কৃষি ও কৃষি সম্বন্ধীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪৩৬ কোটি টাকা। একই সাথে ১৩টি নতুন প্রকল্পের ঘোষণাও রয়েছে এবারের বাজেটে।
পরে বিধানসভায় নিজ অফিস কক্ষে বাজেটের উপর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা বলেন, এই বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর সবকা সাথ সবকা বিকাশের মন্ত্র প্রকাশ পেয়েছে। ফলে রাজ্যের সমাজের সমস্ত অংশের জনগণ এই বাজেটের মাধ্যমে লাভবান হবেন। তিনি বলেন, এই বাজেটে সমাজের সকল অংশের জনগণ যেমন, মহিলা, ছাত্রছাত্রী, যুবসমাজ, তৃতীয় লিঙ্গের জনগণ সহ তপশিলি জাতি, তপশিলি জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কর্মচারি, পেনশনার সহ সকল অংশের জনগণ লাভবান হবেন।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেটে ১৩টি নতুন প্রকল্পের ঘোষণা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে 'মুখ্যমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার' জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৯ কোটি টাকা, “মুখ্যমন্ত্রী ইন্টিগ্রেটেড ক্রপ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে' রাখা হয়েছে ১০ কোটি টাকা, ‘মুখ্যমন্ত্রী ক্রীড়া উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ কোটি টাকা, ‘মুখ্যমন্ত্রী জনজাতি কল্যাণ প্রকল্পের’ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা, রাজ্যের যুব সমাজকে কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ করে তুলতে ‘মুখ্যমন্ত্রী দক্ষতা উন্নয়ণ প্রকল্পের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা, ‘মুখ্যমন্ত্রী নগর উন্নয়ণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সি এম -সাথ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি টাকা।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, এবারের বাজেটে রাজ্যে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্র স্থাপনের সংস্থান রাখা হয়েছে। যা রাজ্য সরকারকে জন পরিষেবা ও সুশাসন প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সহায়তা করবে। পাশাপাশি সরকারের কার্যকারিতা বৃদ্ধির স্বার্থে ও জনগণের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সুগম করার লক্ষ্যে বাজেটে নতুন একটি গুড গর্ভনেন্স ডিরেক্টোরেট তৈরী করার সংস্থান রাখা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, এবারের বাজেট তৈরী করা হয়েছে বিগত ৫ বছরে রাজ্য সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড ও পরিকল্পনার উপর বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিকাঠামোতে বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবারের বাজেটে মূলধনী ব্যয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজ্যের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার খুবই ভালো। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে রাজ্যের গড় উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার (জি এস ডি পি) ছিল ৮৮ শতাংশ।ষা জাতীয়স্তরের হার থেকেও বেশী ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে আশা করা যাচ্ছে। সর্বোপরি ‘এক ত্রিপুরা শ্রেষ্ঠ ত্রিপুরা' গঠনে রাজ্য সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে তা এবারের বাজেটে পরিলক্ষিত হয়েছে।
এদিকে বিধানসভায় বাজেট প্রস্তাব পেশ করে দুপুরে বিধানসভার প্রেস কর্ণারে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী প্রণজিৎ সিংহ রায় বলেন, রাজ্য বিধানসভায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২৭, ৬৫৪ ৪০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ হয়েছে। এই বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ৯.৮৭ শতাংশ বেশী। এবছরের বাজেট প্রস্তাবে মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে ৫,৩৫৮.৭০ কোটি টাকা যা ২০২২-২৩ সালের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় ২২,২৮- শতাংশ বেশী। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৬১১৩ কোটি টাকা। রাজ্যের নিজস্ব কর খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩,৩৬০ কোটি টাকা। কর বহির্ভূত খাতে রাজস্ব আদায় ধরা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে উন্নয়নমূলক ও বিভিন্ন পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত দপ্তরগুলির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী বরাদ্দ ধরা হয়েছে শিক্ষা (বুনিয়াদি, বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সমাজশিক্ষা এবং যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া দপ্তর সহ) দপ্তরের ক্ষেত্রে। এই দপ্তরের মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪৯৩৮.৭৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেট প্রস্তাবের ১৭.৮৬ শতাংশ। পঞ্চায়েত সহ গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৪১৮.৭০ কোটি টাকা যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১২.৩৬ শতাংশ। পূর্ত দপ্তরের (সড়ক ও সেতু, পানীয়জল ও স্বাস্থ্য বিধি এবং জল সম্পদ) জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৬১২.৪২ কোটি টাকা যা মোট বাজেট বরাদ্দের ৯.৪৫ শতাংশ। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪২৩.৬৪ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭৫৫.৬২ কোটি টাকা। কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪৩৬৪১ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী প্রণজিৎ সিংহ রায় বলেন, রাজ্যের অর্থনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ২০২২- ২৩ সালে রাজ্য জিএসডিপি'র বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৮০ শতাংশের মতো যা ওই সময়ে জাতীয় পর্যায়ের বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশী। ওই সময়ে জাতীয় পর্যায়ে বৃদ্ধির হার ছিল ৭.২০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজ্য আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছর জাতীয় পর্যায়ে এই বৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৬.৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবকে ভবিষ্যৎমুখী, প্রবৃত্তি অভিমুখী হিসাবে অভিহিত করে অর্থমন্ত্রী শ্রীসিংহরায় বলেন, এই বাজেট প্রস্তাবে সমাজের সব অংশের মানুষের কল্যাণের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, এবারের বাজেট প্রস্তাবে মুখ্যমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা সহ ১৩টি নতুন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী ইন্টিগ্রেটেড ক্রপ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম, মুখ্যমন্ত্রী স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট স্কিম, মুখ্যমন্ত্রী ট্রাইবেল ডেভেলপমেন্ট মিশন, মুখ্যমন্ত্রী স্যাটেলাইট টাউন ডেভেলপমেন্ট স্কিম, মুখ্যমন্ত্রী নগর উন্নয়ন প্রকল্প, মুখ্যমন্ত্রী দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি।
অর্থমন্ত্রী জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে মুখ্যমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা ২০২৩ নামে একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা যোজনা চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে যা হবে সার্বজনীন এবং প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত পিএম জেএওয়াই প্রকল্পের ধাচে তৈরী করা হবে। তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা ২০২৩ রাজ্যের অবশিষ্ট ৪৭৫ লক্ষ পরিবার পিছু সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকার বীমার সুবিধা প্রদান করবে। সরকারি কর্মচারীরাও এই বীমা প্রকল্পের আওতাভুক্ত হবেন। এই প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকার ৫৯ কোটি টাকা প্রতি বছর ব্যয় করবে।
অর্থমন্ত্রী জানান, আমন ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী ইন্টিগ্রেটেড ক্রপ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (এমআইসিএমপি) প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। এর জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। প্রাণীসম্পদের সার্বিক উন্নয়নে চলতি প্রকল্পগুলিকে সমন্বিত করে মুখ্যমন্ত্রী প্রাণীসম্পদ বিকাশ যোজনা চালু করা হবে। এর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রী মংস্য বিকাশ যোজনায় ১২ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, মাছের পোনার উৎপাদন ইত্যাদি করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী কন্যা আত্মনির্ভর যোজনার জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট স্কিমে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ট্রাইবেল ডেভেলপমেন্ট মিশনের জন্য ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সিএম-সাথ (চিফ মিনিস্টার্স স্কলারসীপ ফর এচিভার্স টুয়ার্ডস হায়ার লার্নিং) প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি টাকা৷ মুখ্যমন্ত্রী দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পে আগামী ৫ বছরে বায় হবে ৫০ কোটি টাকা৷ মুখ্যমন্ত্রী নগর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ১২০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আকাঙ্খা স্কিমের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ কোটি টাকা। মুখ্যমন্ত্রী স্টেট ট্যালেন্ট সার্চ প্রোগ্রামে মহিলা এ্যাথলেটদের উল্লেখযোগ্য পারফরমেন্সের জন্য ৫ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী স্যাটেলাইট টাউন ডেভেলপমেন্ট স্কিমের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থ দপ্তরের সচিব ব্রিজেশ পান্ডে, অতিরিক্ত সচিব আকিঞ্চন সরকার ও উপস্থিত ছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন