নতুন দিল্লি, ১২ মে : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সোমবার রাত ৮টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, গত কিছুদিনে দেশ ভারতের শক্তি এবং সংযম—উভয়েরই সাক্ষী হয়েছে। তিনি ভারতের দুর্ধর্ষ সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজ্ঞানীদের প্রতি সমস্ত ভারতবাসীর পক্ষ থেকে স্যালুট জানান। প্রধানমন্ত্রী ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্যে ভারতের সাহসী জওয়ানদের অসীম সাহস, অটুট মনোবল এবং দুর্জয় স্পৃহার প্রশংসা করেন এবং এই বীরত্বকে দেশের প্রতিটি মা, বোন ও কন্যার প্রতি উৎসর্গ করেন।
তিনি ২২ এপ্রিল পাহলগামে ঘটে যাওয়া বর্বর জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেন, এই নৃশংসতা শুধুমাত্র একটি নিষ্ঠুরতা নয়, বরং দেশের সম্প্রীতিকে নষ্ট করার এক জঘন্য প্রয়াস। অবকাশ যাপন করতে আসা নিরীহ মানুষদের ধর্ম জিজ্ঞেস করে তাদের পরিবার ও শিশুদের সামনেই হত্যা করা হয়—এটি সন্ত্রাসের এক ঘৃণ্য রূপ। তিনি বলেন, পুরো জাতি—প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি সম্প্রদায়, সব রাজনৈতিক দল—একজোট হয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে। সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যারা ভারতের নারীদের মর্যাদায় আঘাত হানতে চেয়েছে, তারা এখন ফল ভোগ করছে।
তিনি বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুধুমাত্র একটি অভিযান নয়, এটি কোটি কোটি ভারতবাসীর আবেগের প্রতিফলন। এই অভিযান ৬ ও ৭ মে-তে বিশ্বের সামনে ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে জঙ্গি ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সুনির্দিষ্ট হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসের শিকড়ে আঘাত হেনেছে। তিনি বলেন, যারা ভেবেছিল ভারত এইরকম দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেবে না, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাহাওয়ালপুর ও মুরিদকির মতো এলাকা—যা বহু বছর ধরেই বিশ্বসন্ত্রাসের কেন্দ্র ছিল—ভারতের ড্রোন ও মিসাইল হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে। ৯/১১, লন্ডন টিউব বোমা বিস্ফোরণ এবং বহু ভারতীয় হামলার সঙ্গে এই অঞ্চলগুলোর যোগসূত্র রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, অভিযানে ১০০-রও বেশি কুখ্যাত সন্ত্রাসী খতম হয়েছে, যাদের অনেকেই দশকের পর দশক ধরে ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছিল। পাকিস্তান যখন সীমান্তে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ভারত তাদের মূল কেন্দ্রে আঘাত হানে। পাকিস্তানের গর্বের এয়ারবেস ও সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। ভারতের প্রতিরোধ দেখে পাকিস্তান হতবাক হয়ে পড়ে এবং ১০ মে ভারতীয় ডিজিজিএমও-র সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধবিরতির আর্জি জানায়। পাকিস্তান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা আগ্রাসন আর চালাবে না। ভারতের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে প্রতিক্রিয়ামূলক অভিযান স্থগিত রাখা হয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতে পাকিস্তানের প্রতিটি পদক্ষেপ মূল্যায়ন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিএসএফ এবং আধাসামরিক বাহিনী সর্বদা সজাগ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ এখন ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের নতুন নীতি—এটি একটি ‘নতুন স্বাভাবিক’। তিনি ভারতের নিরাপত্তা নীতির তিনটি মূল স্তম্ভ ব্যাখ্যা করেন:
সুনির্দিষ্ট প্রতিশোধ – ভারতের উপর সন্ত্রাসী হামলা হলে তার জবাব শক্ত হাতে দেওয়া হবে।
পারমাণবিক ব্ল্যাকমেলের প্রতি অসহিষ্ণুতা – ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হুমকি কার্যকর হবে না; এর আড়ালে থাকা সন্ত্রাসী ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করা হবে।
সন্ত্রাসবাদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য করা হবে না – যারা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেয়, তারাও সমান দায়ী।
প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন, পাকিস্তানি সেনার শীর্ষ কর্মকর্তারা খতম হওয়া জঙ্গিদের জানাজায় অংশ নিয়েছেন, যা প্রমাণ করে পাকিস্তান কতটা রাষ্ট্রপৃষ্ঠপোষিত সন্ত্রাসে জড়িত। তিনি বলেন, ভারত এখন থেকে "সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না, সন্ত্রাস ও বাণিজ্য পাশাপাশি হতে পারে না, রক্ত ও জল একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না" এই অবস্থানেই অটল থাকবে।
তিনি বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ ভারতের সামরিক কৌশলে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছে—ভারত মরুভূমি, পাহাড়, আকাশ ও সাইবার যুদ্ধের সব ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি জানান, ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এই অভিযানে চমৎকারভাবে কার্যকর হয়েছে, এবং বিশ্ব আজ ভারতের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার স্বীকৃতি দিচ্ছে।
বুদ্ধ পূর্ণিমার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তির পথ শক্তির দ্বারা সুরক্ষিত হতে হবে। শক্তিশালী ভারতই শান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে। ভারতের প্রত্যেক নাগরিক যেন সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারে, সেই ‘বিকসিত ভারত’-এর স্বপ্ন পূরণের জন্য সরকার সদা প্রস্তুত। তিনি আবারও ভারতীয় সেনার বীরত্ব এবং ভারতবাসীর ঐক্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে ভাষণ শেষ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন